রাজশাহী যাচ্ছিলেন নওগাঁ থেকে, যাচ্ছিলেন কোনো এক কাজে। বাসের একটানা দুলুনিতে ঘুম ঘুম আসছিল। রাজশাহী হয়তো আর কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে যাবেন।
হ্যাঁ, প্রায়ই কাছাকাছি চলে আসছেন, আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় এমনটাই মনে হচ্ছিল।কিন্তু হঠাৎ বিকট শব্দ। শুধু মনে হলো ভয়ংকর বিস্ফোরণ।
আর কিছু মনে নেই। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালের বিছানায়। কোনোমতে জ্ঞান ফিরেছিল, তাকিয়ে দেখেন এক হাত নেই।
এরপর ফের জ্ঞান হারান। যখন চূড়ান্তভাবে জ্ঞান ফিরল, ততক্ষণে রফিকুল বুঝে গেছেন তিনি জীবন থেকে কী হারিয়েছেন।
১৩ বছর আগের সেই ঘটনা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় রফিকুলকে। এখনো চোখে ভাসে সেই দুঃস্বপ্নের রাত। থেমে যাননি জীবনের প্রতিবন্ধকতার কাছে।
প্রতিবন্ধকতাকে তিনি প্রতিবন্ধকতা মনে করেননি। এক হাত হারিয়েছেন, তাই বলে একেবারে দমে যাননি। এক হাত চলে গেছে বাস দুর্ঘটনায়, অন্য হাত আনায়াসে পাততে পারতেন দুয়ারে দুয়ারে।
কিন্তু না, সে হাতকে মানুষের দ্বারস্থ করেননি, একমাত্র হাতকে নিজের সমস্ত শক্তির উৎস করেছেন। রফিকুল ইসলাম ঢাকার অদূরে কামারপাড়া এলাকায় রিকশা চালান।
এক হাত দিয়ে রিকশার হ্যান্ডেল ধরেন, সেই হাত দিয়ে রিকশা চালনার সব কাজই করে থাকেন।রফিকুলের ভাষ্য, ‘সৃষ্টিকর্তা আমার যে হাত রেখেছেন,
সেটা দিয়েই আমি আমার জীবন চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার এক হাত নেই, সেই দুঃখ অবশ্যই আছে।
তাই বলে অন্য হাত দিয়ে তো আমি ভিক্ষা করতে পারি না। আমি জীবনের সঙ্গে লড়তে চাইছি।জীবনের সঙ্গে যে বোঝাপড়া আমার,
তার কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নই আমি।’ রফিকুল ইসলামের বাড়ি নওগাঁ সদরের নার্সি গ্রামে। দুই ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে।
বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটজন এখনো পড়ে না। রফিকুল বলেন, ‘আমি আমার জীবন নিয়ে অসুখী নই।
দৈনিক রিকশা চালিয়ে যা আয় করি, তাতে সুন্দর চলে যায় আমার।আমার পরিবারের সব খরচ এতেই মিটে যায়।
আমি মানুষের কাছে হাত পাতার কথা চিন্তাও করতে পারি না। আত্মসম্মান বিক্রি করতে পারব না, এটা তো আমার লড়াই। আর জীবন মানেই তো লড়াই,
সেখানে বাধাগ্রস্ত হয়ে পিছু হটলে চলবে না।’ প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি রফিকুলকে এক হাতে রিকশা নিয়ে ছুটতে দেখা যায়।
ডান হাত দিয়ে ব্রেক কষতে হয়, কিন্তু সেই হাত নিয়ে গেছে বাস দুর্ঘটনা। তাই ব্রেক লাগানো হয়েছে বাঁ হাতে। রিকশার বেলের বদলে লাগানো হয়েছে ভেঁপু।
সেটিও বাঁ দিকে। এক হাত দিয়েই সব করেন রফিকুল। সেভাবেই ছুটে যান কামারপড়া থেকে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টর, আব্দুল্লাহপুর, ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল কলেজ, কখনো বা স্টেশন বাজার।